শেখ হাসিনার ‘আক্রোশ ও প্রতিহিংসাতেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বেগম খালেদা জিয়াকে......
সুলতান আহমেদ রাহী
নীতি ও আদর্শে অটুট থাকায় তিনি আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর মার্চে তিনি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি পান।১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন এবং একই বছরের ১০ মে চেয়ারপার্সন পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। টানা ৪০ বছর তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব সফলতা সাথে পালন করে আসছেন।
বিশেষ করে আপসহীন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালুসহ বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। বিএনপির দায়িত্ব নেয়ার পর দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে কোনো রকম সমঝোতা না করেই আপসহীন আন্দোলন করে গেছেন। ফলে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে।
১৯৮৩ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত-দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই বছর সেপ্টেম্বরে জোটের মাধ্যমে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফায় আন্দোলন চলতে থাকে। ওই বছর ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জাতীর সাথে বেঈমানী করে শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতেও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দমে যাননি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল ভেঙে আট দল ও পাঁচ দল হয়ে যায়। এর পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত ও পাঁচ দল নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৭ সাল থেকে বেগম খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন শুরু করেন।
একটানা নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো দেশের প্রথম নারী মুসলিম প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হন। বেগম খালেদা জিয়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) এর দু'বার চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার একটি অনন্য রেকর্ড হচ্ছে- পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতেই তিনিই জয়ী হয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সফলতার সাথে তিনবার দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন।
২০১১ সালের ২৪ শে মে নিউ জার্সি স্টেট সিনেটে ’ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’পদক প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সিনেট কর্তৃক কোন বিদেশিকে এ ধরনের সম্মান প্রদানের ঘটনা এটাই ছিল প্রথম। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই তাকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ সম্মাননা দেয় কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর নিজ পুত্রসহ গ্রেফতার হয়ে পরের বছর ১১ সেপ্টেম্বর তিনি হাইকোর্টের আদেশে মুক্তিপান। সর্বশেষ দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রে শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হয়ে আজ পর্যন্ত বন্দী রয়েছেন। এপর্যন্ত সর্বমোট পাঁচবার তিনি আটক হন। তার বর্তমান বয়স প্রায় ৮০ বছর। দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কারাবন্দী ও গৃহবন্দী হয়ে ২০০৮ সাল থেকে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে হয়। ১৪টি পবিত্র ঈদ তাকে পরিবার ও আত্মীয় ছাড়া একাকি পালন করতে হয়েছে।
গত শুক্রবার মধ্যে রাতে তার ভাড়া বাসা ফিরোজায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে সিসিইউ-তে। এ নিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে ২৩ বার ভর্তি করা হলো এভারকেয়ার হাসপাতালে। তবুও শেখ হাসিনার নোংরা প্রতিহিংসার নেশা শেষ হলো না।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া পায়ে হেঁটে আদালতে প্রবেশ করেন ওইদিনই ঢাকার এই বিশেষ জর্জ আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ৫ বছরের কারাদন্ড দেন।এরপর বেগম খালেদা জিয়া সুস্থসবল ভাবে পায়ে হেঁটে পুলিশের গাড়িতে করে নাজিমউদ্দীন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে আসেন। নাজিমউদ্দীন রোডের পুরনো কারাগারেই ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। এর কয়েক মাস পর কারাগারেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বেগম খালেদা জিয়া। এমনকি এক পযার্য়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান তিনি। সাথে সাথে কারা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রদান করেননি। পরদিন শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন কারা কর্তৃপক্ষ, যে মেডিকেলের ভিসির রয়েছে ডজন খানেক দূর্নীতি মামলা, রয়েছে দূর্নীতির হাজারটা অভিযোগ, ঘুষ ছাড়া নিয়োগ,পদোন্নতি কিছুই হয় না বিএসএমএমইউতে।এছাড়া রয়েছে নিম্ন সেবার মান নিয়ে শতাধিক সাংবাদিকদের প্রতিবেদন। সেই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা শেষে আবারও নিয়ে যাওয়া হয় পরিত্যক্ত এই কারাগারে। এই কারাগারে বেগম খালেদা জিয়া বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত হন। এবং পুরনো রোগের মাত্রাগুলো বাড়তে থাকে যার তেমন কোন দৃশ্যমান চিকিৎসা হয়নি। এরপর বেগম খালেদা জিয়াকে ২য় বারের মতো নেয়া হয়েছিল শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। একদিন থাকার পর তাকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় নাজিমউদ্দীন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে। এইসময় বিএনপি সিনিয়র নেতারা দেখা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীর সাথে। একই সময়ে আইন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। তাদের উভয় পক্ষের একটি দাবি ছিলো খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থ সেটি মন্ত্রীর মাধ্যমে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে কোন সাড়া পাননি বিএনপি নেতারা ও তার আইনজীবীরা।
হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষ এবং বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত এই নির্দেশনা দেয় যে কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়নে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলবে ঘুষ,দূর্নীতি ও নিম্নমানের সেবার আখড়া বিএসএমএমইউ-শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ নেত্রীর রয়েছে যকৃত রক্তক্ষরণ, কিডনি সমস্যা,হাই প্রেসার,ডায়বেটিস, হৃদযন্ত্রের সমস্যা।পায়ের হাটুতে সমস্যা, রক্তে হিমোগ্লোবিন দ্রুত কমে যাওয়া।শরীরে খনিজ অসমতা সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন। দেশী ও বিদেশী উভয়পক্ষের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা একাধিকবার বলেছেন দেশে তার চিকিৎসা সম্ভব নয় দ্রুত তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরন করতে হবে। কিন্তু শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তাকে চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা অনেকে অনেক কথা বলেছেন এমনকি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাও মহান সংসদে দাড়িয়েও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিদ্রুপ তথা অশোভন ও কুরুচিরপূর্ণ মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি এতটাই জঘন্য, অমানবিক, প্রতিহিংসাপরায়ণ তারা। যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার দাবিতে রাজপথে সমাবেশ করছেন তখন স্বয়ং শেখ হাসিনা লন্ডনে বিদ্রূপ করে বলেছেন, ''কেন এত মায়া কান্না! এই মরে যায় যায়, বয়স তো ৮০ বছর! আর কত বছর আর বাঁচবে! মারে আল্লাহ রাখে কে! খালেদা জিয়া অসুস্থ তাকে বিদেশে পাঠাও আহ্লাদ এর শেষ নাই"! এমন কি পদ্মা সেতুতে ফেলে হত্যার হুমকিও জাতিকে শুনতে হয়েছে! শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার হয়ে সেনা সমর্থনে বিদেশী ষড়যন্ত্রের সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর তাকে ক্যান্টনমেন্টের ২৮ বছর বসবাস করা বেগম খালেদা জিয়ার স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে বলপ্রয়োগে তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবার ও দল থেকে একাধিক বার আবেদন করা হলেও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বঞ্চিত হয়েছেন চিকিৎসার অধিকার থেকে। এমনকি তার সাথে সাক্ষাত করতে হলে নিজ দলের নেতা ও পরিবারের সদস্যদের কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে সাক্ষাত করতে হয়।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপর যে অন্যায়, অবিচার, নিষ্ঠুর, নির্মম আচারণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে তা এইদেশে মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণে ছাপ হয়ে থাকবে। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে সুপরিকল্পিতভাবে বিরাজনীতিকরণ করার জন্য, রাজনীতিকে সরিয়ে ফেলার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ও তার সন্তানদের হত্যার চেষ্টা এটা শুরু হয়েছে ওয়ান–ইলেভেন থেকে। সেই চক্রান্তের কারণেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
লেখকঃ শিক্ষার্থী,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Comments