Image description

নিজস্ব প্রতিবেদক  
আরটিএনএন: রাজস্ব আয়ের ঘাটতি মেটাতে ও চড়া খরচের ঋণের চাপ কমাতে ছোট ছোট পকেটে হাত দিচ্ছে সরকার। কর-বহির্ভূত খাত থেকে সরকার যে রাজস্ব পায়, সেগুলো সংগ্রহে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার। 

এজন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংগ্রহ করা কর-বহির্ভুত রাজস্ব (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) দ্রুত সরকারের কোষাগারে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ বিভাগ।

এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাড়তি সুদে ব্যাপক ঋণ করার চাপ কমাতে সরকার যতটা সম্ভব নিজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সে কারণে সরকারের যেখানে যে টাকা আছে, তা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।' 

তিনি বলেন, সরকারি সংস্থাগুলো সাধারণত এ ধরনের আয় সরকারের কাছে অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই জমা দিয়ে থাকে। এরপরও অর্থ বিভাগ যেখানে যে বকেয়া পাওনা রয়েছে, সেগুলো কোষাগারে আনার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে তাগিদ দিচ্ছে।  

ওই কর্মকর্তা জানান, কর-বহির্ভূত রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য কিছু ক্ষেত্রে ফি পুনঃনির্ধারণ করা, অনলাইনে সংগ্রহ ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারি অ্যাকাউন্টে জমার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।   

এর পাশাপাশি ব্যয় না হওয়া অর্থও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি কোষাগারে ফেরত পাঠাতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।  

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে কর-বহির্ভূত রাজস্ব খাত থেকে সরকার ৫০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে এই রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার ৩৮ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এই খাত থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার।

সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৩ লাখ ২৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা—অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ২৯ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করেছে। জুন মাসেও যদি এই হারে রাজস্ব সংগ্রহ হয়, তাহলে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৪৬ হাজার হাজার কোটি টাকারও বেশি ঘাটতি থাকবে। 

এই ঘাটতি মেটানোর উপায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৩ জুন পর্যন্ত সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার প্রাক্কলন করেছিল। কিন্তু আশানুরূপভাবে রাজস্ব আয় না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ২৩ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১১.৬০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ সুদে দিয়ে ঋণ নিয়েছে সরকার। 

যেসব খাত থেকে কর-বহির্ভূত রাজস্ব সংগ্রহ করা হয় 

অর্থ বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে দেওয়া শতাধিক সেবার বিপরীতে কর-বহির্ভূত রাজস্ব সংগ্রহ করা হয়। 

এরমধ্যে আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাশং, অলাভজনক সংগঠনের নিবন্ধন ফি, প্রকৌশল সেবা, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফি, জরিমানা, টেস্টিং ফি, পরিদর্শন ফি, ট্রেড মার্ক নিবন্ধন ফি, পেটেন্ট ডিজাইন নিবন্ধন ফি, দলিল নিবন্ধন, স্টাম্প ও ডাকটিকিট বিক্রি, চাল-গম-ভুষি বিক্রি, সেতু-সড়ক-ফেরির টোল, রেলের যাত্রী, পণ্য, পার্সেল ও অপটিক্যাল ফাইবার ভাড়া এবং ভূ সম্পত্তির ইজারা, নৌযান নিবন্ধন, নৌ খাতে জরিপ ফি, পরিবেশগত ছাড়পত্র ফি, সার্ভে ও সেটেলমেন্ট চার্জ, নামজারি ও জমাখারিজ ফি, ভূমি উন্নয়ন কর অন্যতম। 

এছাড়া সরকারি যানবাহন ভাড়া, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত কাগজপত্র ও স্টেশনারী বিক্রির অর্থ, বিভিন্ন পরীক্ষার ফি, দরপত্র দলিল ফি, জেলা পরিষদের দোকান, ডাকবাংলো ভাড়া, সরকারি স্কুল, কলেজের ভর্তিসহ অন্যান্য ফি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, ফার্ম ও কোম্পানির নিবন্ধন, সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া বিভিন্ন ঋণের সুদ, খনি ও খনিজ দ্রব্রের রয়্যালটি, কৃষিপণ্য বিক্রি ও বীজ প্রত্যয়ন ফি, বিভিন্ন বাহিনীর কাছে রেশন বিক্রি, আগ্নেয়াস্ত্র নিবন্ধন ফি, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ফি, সরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন খাতের আয়, হোটেল-রেস্তোরাঁ নিবন্ধন ফি, বনের বিভিন্ন কাঠ বিক্রি, চারা বিক্রি, বাজেয়াপ্ত নির্বাচনি জামানত, জাতীয় পরিচয়পত্র ফি, কোর্ট ফি থেকেও কর-বহির্ভূত রাজস্ব পেয়ে থাকে সরকার। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান টিবিএসকে বলেন, কর-বহির্ভূত রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরকারকে তিনটি খাতে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ও দক্ষতা নিশ্চিত করে পেশাদারিত্বের সাথে পরিচালনা করতে হবে, যাতে লোকসান কমে মুনাফা বাড়ে। দ্বিতীয়ত, সরকারি সেবার ফি বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ এবং আদায়ে দূর্নীতি বন্ধ করতে হবে। সবশেষে সরকারি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করার ব্যবস্থা করতে হবে। 

কোত্থেকে কত রাজস্ব পাওয়া যেতে পারে

২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে আমদানি-রপ্তানি মুখ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স ফি বাবদ ১৮০ কোটি টাকা এবং যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমুহের নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে ১৭৬ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, বৈশ্বিক কারণে আমদানি-রপ্তানিতে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি নেই। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব সংগ্রহ নিয়ে সংশয় রয়েছে। 

এছাড়া সরকার মনে করছে, বিদায়ী অর্থবছরে দলিল নিবন্ধন থেকে আসবে ২ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। এছাড়া আইন ও বিচার বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন আদালতের ফিসহ অন্যান্য খাত থেকে আসবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।  

সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে আসতে পারে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়ন থেকে ২ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা পাওয়ার প্রাক্কলন করেছে। জননিরাপত্তা বিভাগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে ৯১০ কোটি টাকা পাওয়ার আশা করছে। 

সেতু থেকে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা টোল পাওয়া যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর সড়ক থেকে টোল পাওয়া যাবে ২০০ কোটি টাকা।  

এছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি থেকে ১৬৫ কোটি, মোটরযান নিবন্ধন ফি থেকে ৯৩৪ কোটি, মোটরযান ফিটনেস ফি থেকে ১১১ কোটি, রুট পারমিট ফি থেকে ১০০ কোটি, নম্বরপ্লেট ফি থেকে ১০০ কোটি, এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিস প্রোভাইডার ও মোটরযান এনলিস্টমেন্ট ফি থেকে ৫০ কোটি টাকা পাওয়ার আশা করছে সরকার। সড়ক কর থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

সামগ্রিকভাবে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ৫ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার প্রাক্কলন করেছে। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একজন পরিচালক বলেন, এ বছর গাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় নিবন্ধন ফি থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আসছে না। অন্যান্য ফি থেকেও রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হবে। 

নির্বাচন কমিশনে জমা থাকা বাজেয়াপ্ত নির্বাচনি জামানত, জাতীয় পরিচয়পত্র ফি দ্রুত সরকারি কোষাগারে চাচ্ছে অর্থ বিভাগ। জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বাজেয়াপ্ত নির্বাচনি জামানত হিসেবে সরকার ১২ কোটি টাকা পাওয়ার প্রাক্কলন করেছে। একইভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র ফি থেকে ৮৪ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। 

বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভূমি উন্নয়ন কর খাত থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছে। নামজারি ও জমা খারিজ থেকে ২৬২ কোটি টাকা পাওয়ার প্রাক্কলন রয়েছে। 

বকেয়া আদায়ের উদ্যোগ

ভূমি সংস্কার বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ৩৮টি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়া ছিল ৪৪৮.৮৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নতুন বকেয়া ৮৪.৫৩ কোটি টাকা। পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে মোট কর বকেয়া ৫৩৩.৪১ কোটি টাকা। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত ভূমি উন্নয়ন কর আদায় পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ৫৯.৩১ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

ভুমি সংস্কার বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভুমি উন্নয়ন কর আদায় বাড়ানোর জন্য আগস্টে একটি বিশেষ কর্মশালা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়গুলোকে ডিও লেটার পাঠানো হবে।