নিজস্ব প্রতিবেদক
আরটিএনএন: কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে যারা নাশকতা চালিয়েছে তাদের গ্রেফতারে সারা দেশে চলছে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান। গত পাঁচ দিনে তিন শতাধিক মামলায় পাঁচ সহস্রাধিক আসামি গ্রেফতার হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রতিদিনই ব্লকরেইড হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ ও স্টিল ছবি দেখে নাশকতাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। যেসব স্পটে নাশকতা হয়েছে সেসব স্থানের ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট এগুলো বিশ্লেষণ করে নাশকতার ঘটনায় হতাহতদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ।
পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, সবচেয়ে বেশি মামলা ও গ্রেফতার হয়েছে ডিএমপি এলাকায়। এখানে সব শেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নাশকতার অভিযোগে ২০১টি মামলায় দুই হাজার ২০৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে র্যাব জানিয়েছে, নাশকতার অভিযোগে গত ৫ দিনে ঢাকাসহ সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব স্থানে মামলা ও গ্রেফতার হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-নাশকতার ঘটনায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) এলাকায় ২৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ১৬টি মামলায় ৩২৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। রাজশাহীতে ১৬টি মামলায় ১৭৯ জন গ্রেফতার হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলায় ১১টি মামলা হয়েছে। এতে গ্রেফতারের সংখ্যা ২৯৩ জন। টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ ১০টি মামলায় ১৫০ জনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে নয় মামলায় ৩০৯, রংপুরে সাত মামলায় ৯৬, সিলেটে সাত মামলায় ১০০, ময়মনসিংহে সাত মামলায় ১০৮, সিরাজগঞ্জে ছয় মামলায় ১৪১, দিনাজপুরে পাঁচ মামলায় ৪৪, বরিশালে পাঁচ মামলায় ৭৬, কুমিল্লায় পাঁচ মামলায় ১৩৭, ফরিদপুরে চার মামলায় ১৮ জন, পঞ্চগড়ে দুই মামলায় ২১ জন ও লালমনিরহাটে একটি মামলায় নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে আমরা অনেক নাশকতাকারীকে চিহ্নিত করেছি। জিরো টলারেন্স নীতিতে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। অভিযানে অনেকেই ধরা পড়েছে। যারা এখনো চিহ্নিত হয়নি ম্যানুয়াল ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ এবং স্টিল ছবি পর্যালোচনা করছি। সব নাশকতাকারীকেই একে একে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, নাশকতাকারীরা থানা, ফাঁড়ি, পুলিশের অফিস, ট্রাফিক বক্স, গাড়ির গ্যারেজসহ ২৩৫টি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করেছে এবং ভাঙচুর চালিয়েছে। পুলিশের জিপ, পিকআপ, এপিসি, রেকার, ওয়াটার ক্যানন, মোটরসাইকেল ও অ্যাম্বুলেন্সসহ ২৩৩টি যানবাহনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে। সহিংসতা ঠেকাতে গিয়ে এক হাজার ১৩১ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন তিনজন। তারা হলেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া, ট্যুরিস্ট পুলিশের এএসআই মো. মোক্তাদির ও ডিএমপি প্রটেকশন বিভাগের নায়েক মো. গিয়াস উদ্দিন। এই মুহূর্তে হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন পুলিশের চারজন সদস্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৯ জুলাই রামপুরা থানা, খিলগাঁও পুলিশ বক্স, মৎস্য ভবন ট্রাফিক পুলিশ বস্ক, বনশ্রী এপিবিএন কার্যালয়, নরসিংদী জেলা পুলিশ কার্যালয়, কিশোরগঞ্জে ভৈরবের পুলিশ বক্স, গাজীপুরের টঙ্গী পশ্চিম থানা ও গাছা থানা, বোর্ডবাজার চৌরাস্তা পুলিশ বক্স ও নরসিংদী জেলা কারাগার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৮ জুলাই রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ি, মোহাম্মদপুর পুলিশ বক্স, চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট পুলিশ বক্স, মেরুল বাড্ডায় বিজিবির গাড়ি, মিরপুর-১০ ও সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এদিন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পিবিআই অফিস, রামপুরায় সহকারী কমিশনার (এসি) ট্রাফিকের অফিস ও বগুড়ায় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিস পোড়ানো হয়। ওই সূত্রটি জানায়, সেতুভবন এবং বিটিভি ভবন, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস এবং বিআরটিএসহ সরকারি স্থাপনাগুলোতে যারা হামলা চালিয়েছে তারা ছাত্র নয় বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, কারা হামলা চালিয়েছে, তা আমরা জানি। সে অনুযায়ী আমরা নাশকতাকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনছি। তিনি বলেন, সহিংসতার সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের মারলে বিভিন্ন অঙ্কে অর্থ দেওয়ার ঘোষণা ছিল। বগুড়ার যুবদল নেতা নুরে আলম সিদ্দিকি পিটন লন্ডন থেকে নির্দেশনা পান, পুলিশ মারলে ১০ হাজার এবং ছাত্রলীগ মারলে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এ ঘোষণার পর মাঠে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয় নুরে আলম সিদ্দিকির দুলাভাই মো. আব্দুল আজিজ ওরফে সুলতানকে। আজিজ ছাত্রদের মিছিলে টাকার বিনিময়ে টোকাই ও ছিন্নমূল শ্রেণির লোকদের আন্দোলনে ঢুকিয়ে দেন। এরপর তাদের দিয়ে দেশব্যাপী হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি ক্যাডারদের নির্দেশনা দিয়ে আসছিলেন। টাকার বিনিময়ে টোকাই ও ছিন্নমূলদের দিয়ে রাজধানীর উত্তরা ও আব্দুল্লাহপুরসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছেন, সহিংসতাকারীরা যেন ঢাকা শহর না ছাড়তে পারে, সেই লক্ষ্যে ডিএমপি পরিকল্পনা করছে। সন্ত্রাসীরা যেখানেই থাকুক, তাদের গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে। এখন পর্যন্ত ২০০টি মামলায় দুই হাজার ১০০ জনের বেশি সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আরও কিছু মামলা দায়ের হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যারা বিটিভি ভবনে হামলায় জড়িত ছিল, যারা সেতুভবনে হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত ছিল, গ্রেফতার দুই হাজার ১০০ জনের মধ্যে প্রত্যেকের কন্ট্রিবিউশন ছিল। তিনি বলেন, হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞে জড়িত জামায়াত ও বিএনপি চক্রকে ধরার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, ডিএমপি তাই করবে। সন্ত্রাসীদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে। এই কাজ আরও বেগবান করা হবে। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বলেন, গত দু-তিন দিন যাবৎ সন্ত্রাসীরা গা-ঢাকা দিয়ে আছে। আমাদের ব্লকরেইড চলমান রয়েছে।
ব্লকরেইড ছাড়াও ঢাকায় দিন-রাতে পুলিশের অপারেশন চলমান রয়েছে। যারা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করেছে, তাদের কালো হাত আইনগতভাবে ভেঙে দেওয়া হবে।
ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কে এন রায় নিয়তি বলেন, সহিংসতা-নাশকতার ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্য ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার ৭৩ মামলায় ১ হাজার ৭৫৮ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আর বৃহস্পতিবার ১২৮ মামলায় ৪৫১ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করেছে ২০১ জনকে।