Image description

নিউজ ডেস্ক  
আরটিএনএন: ক্যামেরার রিল আর নেগেটিভের কথা হয়ত অনেকেরই মনে আছে। একটা সময় ক্যামেরা ছিল পুরোটাই ফিল্মনির্ভর। তখন ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তা দেখা যেত না। এজন্য বেশ সময় অপেক্ষা করতে হতো। আগে ফিল্ম শেষ হবে, তারপর সেটি স্টুডিওতে বা ল্যাবে যাবে, তারপর বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা ওয়াশ শেষে হাতে আসবে ছবি। 

দিন বদলেছে, প্রযুক্তির কল্যাণে এসেছে আধুনিক বা ডিজিটাল ক্যামেরা। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের টুলস, যেগুলোর ব্যবহারে একটি ছবিকে ইচ্ছামতো এডিট (সম্পাদনা) করা যায়। তবে এখনও অনেকে আছেন যারা ডিজিটাল এ যুগে এসেও অ্যানালগ পদ্ধতিতে ছবি সম্পাদনা করেন, ছবি তুলতে ভালোবাসেন। 

অনেক বছর ধরেই ফিল্ম নেগেটিভ থেকে ছবি তৈরির কাজ করছেন সিলভিও কোহেন। কোহেন পুরানো ক্যামেরা এবং নতুন ফিল্ম ব্যবহার করে ৩৫ মিমি. এবং মাঝারি ফরম্যাটের ফিল্ম নিয়ে কাজ করেন। 

তিনি বলেন, 'যখন আমি আমার বন্ধুদের বলি যে আমি এখনও ফিল্ম নেগেটিভ থেকে ছবি তৈরি করি, তখন তারা হাসাহাসি করে। তবে আমার কাছে এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি।'

ফোর্টিন্থ স্ট্রিট ফটো নামের একটি ফটো ল্যাবে কাজ করেন কোহেন। নিউ ইয়র্ক শহরের বেঁচে থাকা কয়েকটি স্টুডিওর মধ্যে এটি একটি, যারা এখনও অ্যানালগ পদ্ধতিতে পুরোনো ফিল্ম নেগেটিভ থেকে ছবি তৈরি করে। 

এক শতাব্দী ধরে এই একই কাজ করে আসছেন তিনি, দেখেছেন এর উত্থান-পতন। ২০০০-এর দশকে অ্যানালগ ফিল্মের পতন থেকে শুরু করে ২০২০-এর দশকে জেনারেশন জেডের আবার নতুন করে আবিষ্কার সবকিছুরই সাক্ষী হয়েছেন তিনি। 

অ্যানালগ ক্যামেরার সাথে মূলত মিলেনিয়ালরা (১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ এর মধ্যে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিরা) পরিচিত, এখন জেনারেশন জেডের তরুণরাও সে মুহূর্তগুলোর অভিজ্ঞতা পেতে চায়।

অ্যানালগ ক্যামেরার ক্ষেত্রে রোল তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ছবিটা কী হবে বা কেমন হবে তা জানার জন্য একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। এটি অনেক তরুণের কাছে সম্পূর্ণভাবে নতুন এক অভিজ্ঞতা।

কোভিডের লকডাউনের সময়ে অ্যানালগ ছবির জনপ্রিয়তা আবার বাড়লেও, কোহেন লক্ষ্য করেছেন ছবি তৈরির পর নেগেটিভ রিল ফেরত নিতে গ্রাহকরা আর খুব একটা আগ্রহী না। 

কোহেন বলেন, 'তারা এখন আর নেগেটিভ নিতে আসেন না, মোটে ১০ শতাংশ গ্রাহক তাদের ফিল্মের রোলের জন্য আবার ফেরত আসেন।'

কোহেনের একজন সহকর্মী জানান, এই হার পাঁচ শতাংশ এবং আরেকজন রসিকতা করে পাশ থেকে বলে ওঠেন, 'পাঁচও নয়, ফেরত আসার হার শূন্য শতাংশ।' 

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বাণিজ্যিক ফিল্ম ল্যাবগুলোও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। 

তাদের সীমিত স্টোরেজ স্পেসগুলো গ্রাহকদের ফেরত না নেয়া ফিল্ম নেগেটিভ দিয়ে ভরে আছে। তারাও বুঝে ওঠতে পারছেন না কী করবেন! ফিল্ম নেগেটিভগুলো কি ফেলে দেবেন, নাকি ফেরত নিতে ভুলে যাওয়া আলোকচিত্রীদের নেয়ার অপেক্ষা করবেন। 

প্রিন্ট করা ছবি থেকেও, একজন আলোকচিত্রীর কাছে ছবি ফিল্ম নেগেটিভ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। 

কপিরাইট আইনজীবী ডেভিড ডিল ব্যাখ্যা করেছেন যে ছবির নেগেটিভের মালিকানা এবং কপিরাইটের মালিকানা পৃথক হয়ে গেলে একটি বড়সড় আইনি সমস্যা তৈরি হয়। নেগেটিভ হলো প্রিন্ট করা ছবির মূল উৎস আর অন্যদিকে কপিরাইট হলো ছবিগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হয় তা নিয়ন্ত্রণ করার আইনি অধিকার। যখন এই দুটি জিনিস একই ব্যক্তির মালিকানাধীন থাকে না, তখন এটি অনেক আইনি বিভ্রান্তি এবং বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।

সহজ ভাষায় বললে, যার কাছে ছবির নেগেটিভ আছে সে চাইলে আবার ছবি প্রিন্ট দিতে পারবে, তবে এটি করার তার আইনি অধিকার বা স্বত্ব নেই। অন্যদিকে, মূল নেআলোকচিত্রশিল্পীর আইনি অধিকার থাকলেও নেগেটিভ না থাকায় তার ছবি প্রিন্ট করার উপায় নেই।

বর্তমানে বেশিরভাগ ফিল্ম স্টুডিওগুলো গ্রাহকদের ফিল্ম নেগেটিভগুলো স্ক্যান করে এর ডিজিটাল কপি তাদের ই-মেইলে পাঠিয়ে দেয়।

লন্ডনের অ্যাপারচার প্রিন্টিংয়ে ১৫ বছর ধরে কাজ করা ডেভেলপার রিচার্ড ড্যামেরি বলেন, 'আগে নেগেটিভ ফেরত নিতে মানুষ ভুলত না কারণ, তাদের সশরীরে এসে ছবির প্রিন্ট করা কপি নিয়ে যেতে হতো। কিন্তু এখন সবকিছুই আপলোড করে দেয়া হয়, যার ফলে তারা আর নেগেটিভ নিতে আসেন না, ভুলে যান।'

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অনেকে হয়ত উপলব্ধিও করতে পারবেন না, আলোকচিত্রীর অ্যানালগ ক্যামেরার ফিল্মের ছবিগুলো কীভাবে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা ও প্রক্রিয়ার পর তার আসল রূপ পায়। 

জেন-জি প্রজন্মের তরুণতরুণীদের জন্য এটা কথাটা আরও বেশি খাটে। কারণ তাদের হাত ধরেই নতুন করে আবার এই অ্যানালগ ক্যামেরার ছবির সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। 

করোনা মহামারির পর থেকে এই শিল্পের চাহিদা বেড়েছে। কেবল লাইকার মতো বিখ্যাত ব্র্যান্ডই নয়, ফুজিফিল্মের মতো ক্লাসিক ডিসপোজেবল ক্যামেরাও আবার ফিরে এসেছে বাজারে। অনেক তরুণ ফটোগ্রাফাররা ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটের মতো অ্যাপগুলোর কৃত্রিম ফিল্টারের এক্সপোজারের ছবি থেকে অ্যানালগ ক্যামেরায় তোলা ছবিকেই বেশি উপভোগ করছেন। 

ডিজিটাল ক্যামেরার উত্থান সত্ত্বেও অ্যানালগ ফিল্ম ফটোগ্রাফি বেশ কয়েকবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৪ সালে ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারে আধিপত্য বিস্তার করলেও নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল ২০১১ সালের মধ্যে আবার 'অ্যানালগ নবজাগরণ' ঘটবে। ২০১৭ সালেও টাইম ম্যাগাজিন একই প্রত্যাবর্তনের কথা জানায়। ২০২২ সালে, অ্যাক্সিওস জানিয়েছিল যে মহামারির পর চাহিদা বাড়ায় ফিল্ম রোলের দাম বাড়ছে। এটি প্রমাণ করে অ্যানালগ ফিল্ম ফটোগ্রাফি কখনও পুরোপুরি বিদায় নেয়নি, বারবার ফিরে এসেছে এবং জনপ্রিয় রয়েছে। 

নোলিটার ব্লিকার ডিজিটাল সলিউশনের মালিক নীল কুমার ১৮ মাস আগে একটি নতুন নীতি শুরু করেছেন। ছবি প্রিন্টের পর নেগেটিভ আর প্রয়োজন হবে কিনা গ্রাহকদের জিজ্ঞেস করে নেন তিনি। 

তিনি বলেন, 'আমি আমার গুদামঘরে নেগেটিভগুলো সংরক্ষণ করতাম, কিন্তু এখন আর সেখানে কোনো জায়গা বাকি নেই। নেগেটিভ দিয়ে আমার পুরো ঘর ভরে গেছে।' 

নেগেটিভ ফেরত নেয়ার জন্য গ্রাহকদের এখন তিনি ৩০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেন। যদিও তিনি ৯০ দিন পর্যন্ত নেগেটিভগুলো সংরক্ষণে রাখেন, যদি এর মধ্যে তাদের প্রয়োজন হয়।

এমমেট বাটলারের পরিবার ৫০ বছর ধরে ডাবলিনে 'কনস ক্যামেরা' নামের প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছে। তারাও এখন তাদের গ্রাহকদের জিজ্ঞেস করে নেয়, ফিল্ম নেগেটিভগুলো ফেরত নিতে তারা আর আসবেন কিনা। 

পেশাদার ফটোগ্রাফার এবং কোপেনহেগেনের একটি ল্যাবের সহ-মালিক আন্দ্রেয়াস ওলেসেন এভাবে নেগেটিভ ফেলে দেয়াটা তার জন্য কঠিন বলে মনে করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন যে এগুলো ফটোগ্রাফির নৈপুণ্যের জন্য অপরিহার্য। 

পরিত্যক্ত ফিল্ম নেগেটিভ বরং আরও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। ছবির স্বত্বাধিকারের মালিক কে হবেন তা নিয়ে বিবাদ দেখা দেয়। 

আইনজীবী ডেভিড ডিল বিষয়টি ভালো করেই জানেন। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি শিকাগোর একটি আদালতে বিখ্যাত স্ট্রিট ফটোগ্রাফার ভিভিয়ান মাইয়ারকে নিয়ে একটি মামলায় জড়িত ছিলেন। মাইয়ার ১৯৫০-এর দশক থেকে হাজার হাজার ছবি তুলেছিলেন। 

তবে একজন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট নিলামে তার নেগেটিভগুলো কিনে নেয়ার পর তার তোলা ছবিগুলো জনসম্মুখে আসে। এরপরে শুধু নেগেটিভ-ই নয়, তার ছবির স্বত্বের মালিক কে তা নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হয়। মামলাটি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।

শৌখিন আলোকচিত্রী ভিভিয়ান মাইয়ারের মতো আপনিও যে মৃত্যুর পর আপনার তোলা ছবির জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে নৈপুণ্য ও সৃষ্টিশীল নিদর্শন হিসেবে ফিল্ম নেগেটিভগুলো সংরক্ষণ করে রাখতেই পারেন। 

ওলেসেন বলেন, ৫০ বছর পর হয়ত তার নাতি-নাতনির কাছে ডিজিটাল হার্ড ড্রাইভ বা সিডিতে সংরক্ষিত ছবিগুলো যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে নাও থাকতে পারে। কিন্তু তার শতাব্দী পুরোনো নেগেটিভগুলো তখনও ব্যবহারযোগ্য থাকবে। 

তিনি বলেন, 'আমি চাইলে আকাশের দিকে তাক করে রেখেই আলোর সাহায্যে ছবিগুলো উপভোগ করতে পারব, কোনো বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই।'